নিরাপদ আমিষের জন্য প্রকৌশলীর সংগ্রাম

বর্তমানে দেশে আমিষের চাহিদা পূরণে অন্যান্য খাবারের পাশাপাশি ভূমিকা রাখছে মাছ ও মাংস। তবে মাছের চেয়ে মাংসের চাহিদা বেশি থাকায় খাবারে মাংস ছাড়া এক বেলা চিন্তা করা যায় না। মাংসে জনপ্রিয়তার ভিড়ে দেশের নিরাপদ মাংস উৎপাদনে তেমন নজরদারি নেই।


বাণিজ্যিক কারণে দেশের খামারিরা তাদের পালন করা মুরগিতে অধিক পরিমাণে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার করেন। এতে একদিকে মানুষের শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা ধ্বংস হচ্ছে, আবার শরীর হারাচ্ছে প্রতিরোধক্ষমতা।বর্তমানে দেশে আমিষের চাহিদা পূরণে অন্যান্য খাবারের পাশাপাশি ভূমিকা রাখছে মাছ ও মাংস। তবে মাছের চেয়ে মাংসের চাহিদা বেশি থাকায় খাবারে মাংস ছাড়া এক বেলা চিন্তা করা যায় না। মাংসে জনপ্রিয়তার ভিড়ে দেশের নিরাপদ মাংস উৎপাদনে তেমন নজরদারি নেই।


বাণিজ্যিক কারণে দেশের খামারিরা তাদের পালন করা মুরগিতে অধিক পরিমাণে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার করেন। এতে একদিকে মানুষের শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা ধ্বংস হচ্ছে, আবার শরীর হারাচ্ছে প্রতিরোধক্ষমতা।ইউএসডিএ এবং ইউরোপিয়ান অর্গানিক গাইডলাইন অনুসারে জিরো অ্যান্টিবায়োটিক ও অর্গানিক মুরগি পালনের জন্য নিজস্ব ফিড মিল স্থাপন করে মুরগির জন্য কোনো রকম অ্যান্টিবায়োটিক, গ্রোথ প্রমোটার, মিট বোন মিল ও হরমোন ফ্রি ফিড তৈরি করছেন মো. ইমরুল হাসান। খাবারের গুণগত মান উন্নত করার জন্য চীন থেকে নিজস্ব ডিজাইনে দানাদার খাবার তৈরির মেশিন সংগ্রহ করেছেন তিনি


অর্গানিক চিকেন (Organic Chicken) ফার্মের প্রতিষ্ঠাতা প্রকৌশলী মো. ইমরুল হাসান ২০০৩ সালে বুয়েট থেকে কম্পিউটার সায়েন্স পাস করার পর দীর্ঘদিন দেশে-বিদেশে টেলিকম ও আইটি খাতে সফলতার সঙ্গে কাজ করেন। পেশাগত কারণে দীর্ঘদিন লন্ডন, মিসর, ফিলিপিন, আরব আমিরাতে থাকার পর ২০১৪ সালে দেশে ফিরে আইটি, পর্যটন ও কৃষিভিত্তিক বিভিন্ন খাতে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন। ব্রিটিশ নাগরিক হওয়ার সুযোগ থাকলেও দেশের জন্য কিছু করার চিন্তা থেকে ফিরে আসেন।


জানা গেছে, ইমরুল হাসানের খামারে প্রায় চার হাজার মুরগি রয়েছে। এসব মুরগি ব্রয়লার, কালার বার্ড ও প্রিমিয়াম রোস্টার প্রজাতির। নির্দিষ্ট সময়ে বিক্রির উপযোগী হলে মুরগিগুলো তিনি নিজস্ব উপায়ে প্রস্তুত করে মাইনাস ২২ ডিগ্রি তাপমাত্রায় হিমায়িত গাড়িতে করে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার বাড়ি বাড়ি নিজেই পৌঁছে দেন।

খামারটির দেখাশোনার দায়িত্বে নিয়োজিত আছেন মনির হোসেন। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২০২০ সালের ডিসেম্বরের শীতকালে খামারটির যাত্রা শুরু হয়। গরম আসতেই পরপর দুটি ব্যাচের অধিকাংশ মুরগি মারা যায়। ব্যাপক ক্ষতি ঠেকাতে স্যারকে (প্রকৌশলী ইমরুল) অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হলেও তিনি তাতে অস্বীকৃতি জানান। তবে মুরগিগুলো মারা যাওয়ার কারণ খুঁজতে থাকেন তিনি। পরে খামারের ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক পরিবর্তন আনেন। বয়সভেদে মুরগিগুলোকে ভিন্ন তাপমাত্রায় রাখলেই মূলত মৃত্যুহার কমিয়ে আনা সম্ভব, সে মোতাবেক তিনি কাজ শুরু করেন। কয়েক মাস বিরতি দিয়ে খামার ও আশপাশ জীবাণুমুক্ত (বায়োসিকিউরিটি) করে ও নানা ধরনের প্রযুক্তি, বিশেষ করে অটোমেটিক তাপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবহারে নতুনভাবে গড়ে তোলা হয় খামারটি। বৃহৎ পরিসরে খামার সম্প্রসারণের জন্য পাশে ১৮ বিঘা জমি ইজারা নেওয়া হয়েছে। যেখানে উন্মুক্ত অবস্থায় প্রাকৃতিকভাবে জিরো অ্যান্টিবায়োটিক অর্গানিক পদ্ধতিতে মুরগি পালন করা হবে।


প্রকৌশলী ইমরুল হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, নতুন প্রজন্মের কাছে মাংস খুবই জনপ্রিয় খাবার। অথচ দেশে এখনো নিরাপদ পোলট্রি মাংস উৎপাদনে নজরদারি গড়ে ওঠেনি। পোলট্রি খামারে বাণিজ্যিক খাবার, অধিক পরিমাণ ও অযাচিত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ফলে আমাদের জীবনের জন্য হুমকি তৈরি হচ্ছে। আমাদের শরীরের ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া দূর করার জন্য আমরা অ্যান্টিবায়োটিক খেয়ে থাকি, মাত্রাতিরিক্ত ও অপ্রয়োজনীয় অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণের কারণে দেহের বিদ্যমান ব্যাকটেরিয়া ধীরে ধীরে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে ওঠে।


ফলে এসব প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া শরীরের সংক্রমণ প্রতিরোধের ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিককে প্রতিরোধ করে, যা রোগের বিরুদ্ধে সাড়া দেয় না। অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ ব্যাকটেরিয়া শুধু ওষুধের মাধ্যমে আমাদের শরীরে তৈরি হয় না, আমরা প্রতিদিন যে খাবার খাচ্ছি—বিশেষ করে মাংস—তা থেকেও এই অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ ব্যাকটেরিয়া আমাদের শরীরে প্রবেশ করতে পারে।


যুক্তরাষ্ট্রের ফুড ও ড্রাগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থার (এফডিএ) বরাত দিয়ে তিনি জানান, যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিকের ৮০ শতাংশ ব্যবহৃত হয় ভেটেরিনারিতে এবং মুরগি ও শূকরের ক্ষেত্রে গরু-ছাগল-ভেড়া চেয়ে প্রায় ১০ গুণ বেশি অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়। প্রাণীতে এই অ্যান্টিবায়োটিক প্রধানত রোগের প্রতিষেধক ও দ্রুত ওজন আসার জন্য ব্যবহার করা হয়ে থাকে।


হার্ভার্ডের এক গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, মুরগিতে ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিক মানুষের সংক্রমিত প্রতিরোধব্যবস্থাসহ দুর্বল বৃদ্ধ, এইচআইভি এইডসে আক্রান্ত, ক্যানসার বা দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহজনিত অবস্থার জন্য চিকিৎসা করা লোকদের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে বলে জানান এই প্রকৌশলী।


নিরাপদ মাংস উৎপাদনে খামারিদের আগ্রহ তৈরি ও নিরাপদ মাংস পৌঁছে দিতেই অর্গানিক খামার গড়ে তুলেছেন, এমনটা জানিয়ে ইমরুল হাসান বলেন, আমাদের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার প্রয়োজনেই নিরাপদ খাবার খুবই জরুরি। আমার খামারের উৎপাদিত জিরো অ্যান্টিবায়োটিক মুরগি ঢাকা শহরের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও অচিরেই বিভাগীয় শহরে অর্গানিক চিকেন ফার্মের কার্যক্রম শুরু হবে। একটি সুন্দর ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নিরাপদ মাংস উৎপাদন এখন আমাদের হাতের মুঠোয়।


গ্রাহক পর্যায়ে জিরো অ্যান্টিবায়োটিক ও অর্গানিক মুরগি পৌঁছে দিতে তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও একটি ওয়েবসাইট তৈরি করেছেন। অর্গানিক চিকেন ফার্মের ওয়েবসাইট https://organikchicken.com%2C/ ফেসবুক পেজ fb/organikchic ও ০১৮১০০৭৭৭১৮ এই নম্বরে যোগাযোগ করে অর্ডার করা যায়।


গাজীপুর জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. উকিল উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের এলাকায় প্রান্তিক খামারিরা যখন অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করেন, তখন আমরা নির্দেশনা দিই ডোজ শেষ হওয়ার ১০ দিন পর মুরগিগুলো বিক্রি করতে। কারণ, ১০ দিন পর ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিকের কোনো কার্যকারিতা থাকে না। সরকার এগুলো বিভিন্নভাবে নজরদারির চেষ্টা করছে। তবে জিরো অ্যান্টিবায়োটিক সত্যিই ভালো দিক। যেটা শতভাগ অর্গানিক। এতে কোনো ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা নেই।


তিনি বলেন, আমরা প্রতিনিয়তই স্বাস্থ্যসচেতন হচ্ছি। ফলে এখন অনেকেই অর্গানিক খাদ্যপণ্য বেশি দামে কিনতে কুণ্ঠাবোধ করে না। যেহেতু গাজীপুরে জিরো অ্যান্টিবায়োটিক অর্গানিক খামার গড়ে উঠেছে, তাই এখন অনেকেই এতে উৎসাহিত হবে। আমরা এমন খামারিদের পাশে থেকে সহায়তা করব।


Courtesy: Dhaka Post

সম্ভাবনা জাগাচ্ছে প্রকৌশলী ইমরুলের অর্গানিক পোলট্রি খামার