বিদেশে লোভনীয় চাকরি ছেড়ে প্রকৌশলী ইমরুল কেন অর্গানিক চিকেনের খামার দিলেন?

অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের কারণে সংশ্লিষ্ট ব্যাকটেরিয়া জন্ম নেয় ওই প্রাণীর শরীরে, ডিম-দুধ-মাংসের মাধ্যমে এসব ব্যাকটেরিয়া ছড়িয়ে পড়ছে মানুষের শরীরেও। বাড়ছে কিডনি, লিভার জটিলতা, আলসার, হৃদরোগ, ক্যান্সারের ঝুঁকি। মানবেদেহে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স বা অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরির মতো ভয়াবহ আশঙ্কা তো আছেই।


বাঙালি নাকি মাছে-ভাতে বাঙালি! আসলেই কী তাই? 


২০২০ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশের সরকারি এক হিসাব বলছে, দেশে প্রতি বছর শুধু ব্রয়লারের মুরগী খাওয়া হয় ৫২৫ মিলিয়ন! প্রাণিজ আমিষের জন্য দেশের মানুষের মুরগীর প্রতি এই প্রবল নির্ভরশীল হওয়ার বিষয়টি প্রভাবিত করে প্রকৌশলী ইমরুল হাসানকে। 


পড়তেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কম্পিউটার সায়েন্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে। কাজ করেছেন দেশের বাইরের বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানিতে। পারিবারিক কারণে ২০১৪ সালে দেশে ফেরেন ইমরুল হাসান। ফিরে দিয়েছিলেন ছাগল আর দুগ্ধ খামারও। সবই ছিল পরীক্ষা-নীরিক্ষা। মাঝে করোনায় আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী হন। সেরে ওঠার পর ভাবলেন, এ যাত্রায় বেঁচে গেছেন যেহেতু উঠে পড়ে লেগে ভালো কিছু করতে হবে। দেশে থেকে মানুষের উপকারে কাজ করার চিন্তা থেকেই শুরু হয় অ্যান্টিবায়োটিকমুক্ত মুরগীর খামারের যাত্রা।


বাংলাদেশের মানুষের প্রাণিজ আমিষের অন্যতম প্রধান উৎস হয়ে উঠেছে মুরগীর মাংস। কিন্তু মুরগিকে দ্রুত বড় করতে ও বিভিন্ন সংক্রামক রোগ প্রতিরোধে নিয়মিত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয় বাণিজ্যিক মুরগীর খামারগুলোতে। বিভিন্ন ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক একসঙ্গে মিশিয়ে ব্যবহার করেন খামারিরা, মুরগীর খাবার ও পানিতেও মেশানো হয়।


এ বিষয়টি নাড়া দেয় তাকে, অ্যান্টিবায়োটিকের ভয়াবহ প্রভাব জানা থাকায় এ নিয়ে কাজ করবেন ঠিক করেন। গাজীপুরের কালিয়াকৈরের বড়ইতৈলিতে নিজ গ্রামেই মুরগীর খামার প্রতিষ্ঠা করে। নাম 'অরগানিক চিকেন'।


দেশের পশুখাদ্য আইন অনুযায়ী, কোনো প্রাণীকে মোটাতাজা করার কাজে ব্যবহৃত পশুখাদ্য ও পোলট্রি ফিডে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। শুধু চিকিৎসার কাজেই অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের অনুমতি রয়েছে। মৎস্যখাদ্য ও পশুখাদ্য আইন, ২০১০ এর ১৪ ধারার ১ উপ-ধারায় বলা আছে, 'মৎস্যখাদ্য ও পশুখাদ্যে এন্টিবায়োটিক, গ্রোথ হরমোন, স্টেরয়েড ও কীটনাশকসহ অন্যান্য ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করা যাইবে না'৷


আইনগতভাবে নিষিদ্ধ হলেও বাণিজ্যিক খাবারগুলোতে থেমে নেই অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার। অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের কারণে সংশ্লিষ্ট ব্যাকটেরিয়া জন্ম নেয় ওই প্রাণীর শরীরে, ডিম-দুধ-মাংসের মাধ্যমে এসব ব্যাকটেরিয়া ছড়িয়ে পড়ছে মানুষের শরীরেও। বাড়ছে কিডনি, লিভার জটিলতা, আলসার, হৃদরোগ, ক্যান্সারের ঝুঁকি। মানবেদেহে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স বা অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরির মতো ভয়াবহ আশঙ্কা তো আছেই। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর বলছে, ২০৫০ সাল নাগাদ এক কোটি মানুষের মৃত্যু হবে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের কারণে। এখনই এ কারণে প্রতিবছর মৃত্যু হচ্ছে সাত লাখ মানুষের।


ভয়াবহ এই চর্চা থেকে বেরিয়ে আসতেই প্রতিষ্ঠিত হয় ইমরুলের 'অরগানিক চিকেন'। ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব এগ্রিকালচারের (ইউএসডিএ) গাইডলাইন অনুসরণ করে খামারটি পরিচালনা করা হয়। মুরগীর জন্য স্বাস্থ্যকর খাবার, সঠিক পুষ্টির যোগান নিশ্চিত করা আর সুস্থ রাখতে অনুসরণ করা হয় আন্তর্জাতিক এ গাইডলাইন। 


মুরগীকে কোনো ধরনের বাণিজ্যিক ফিড খাওয়ানো হয় না। নিজেরাই তৈরি করেন মুরগীর খাবার। খাবারে আছে বৈচিত্র্যও। ফিড ছাড়াও লালশাক, সজনেপাতা, ভূট্টার মতো খাবারও দেওয়া হয়। মুরগীর ফিড বা পানিতে তো নয়ই, চিকিৎসার ক্ষেত্রেও অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার করা হয় না। অরেগানো নামের প্রাকৃতিক একটি অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়। বিভিন্ন ভেষজ উপাদান দিয়েও চলে চিকিৎসা। এই খামারের প্রধান অগ্রাধিকার মুরগী যাতে অসুস্থ না হয়। যে কোনো প্রাণীর নিজস্ব খাদ্যাভ্যাস, পরিবেশ, তাপমাত্রা এসব বজায় রাখলেই অসুস্থ হওয়ার প্রবণতা কমে আসে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে দেওয়া হয় অ্যাপল সিডার ভিনেগার। তারপরও মুরগী অসুস্থ হয়ে গেলে অ্যান্টিবায়োটিক না দিয়ে প্রাকৃতিক উপায়ে সারিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়।


এক কোটির মতো বিনিয়োগ করে খামারের যাত্রা শুরু হয়। খামারের অবকাঠামো, রক্ষণাবেক্ষণের কাজেই খরচটা বেশি হয়। প্রতি ব্যাচে কতোগুলো মুরগী ডেলিভারি দেওয়া হচ্ছে, মুরগীর ওজন কেমন হচ্ছে এর উপর নির্ভর করে ব্যবসায়ের লাভ। কোনো ব্যাচের মুরগীর ওজন কম হলে লাভ কমে আসে। 


খামারে বর্তমানে কালার বার্ড আছে তিন হাজার, ব্রয়লার দেড় হাজার। ব্রয়লারের সংখ্যা বাড়ানোর পরিকল্পনাও আছে। বেশিরভাগ বেচা-কেনাই হয় অনলাইনের মাধ্যমে। এখন পর্যন্ত শুধু ঢাকা শহরের মধ্যেই ডেলিভারি দেওয়া হয়, ডেলিভারি চার্জ ফ্রি। প্রতি অর্ডারে ব্রয়লারের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন পাঁচটি ও কালার বার্ডের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ছয়টি মুরগী অর্ডার করতে হয়। গ্রাহকদের সঙ্গে যোগাযোগের সুবিধার জন্য ভবিষ্যতে মোবাইল অ্যাপ বানানোর পরিকল্পনাও আছে। 


খামারের কিছু অংশে কিছু মুরগী ছেড়ে পালা হয়। পুরো খামারে আছে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা। আবহাওয়া অনুযায়ী তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থাও আছে। সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা হয় কম্পিউটারের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে। সার্বক্ষণিক তাপমাত্রা মনিটরিংয়ের সেন্সর, কুলিং প্যাড ব্যবহার করে আর খাবারে পরিবর্তন এনে অ্যান্টিবায়োটিক ছাড়াই মুরগী বড় করতে সফল হন তিনি।


গত বছরের ডিসেম্বরে খামার দেওয়ার পর থেকে বেশ কয়েকবার বড় ধরনের বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, কয়েক ব্যাচ মুরগীর মর্টালিটি রেট বেশি হওয়ায় বড় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন কয়েকবার। নিজেদের ভুলগুলো শুধরে নিয়ে বর্তমানে মৃত্যুহার কমিয়ে এনেছেন ২-৩ শতাংশে। 


'আমরা ট্রায়াল-এররের মধ্য দিয়ে এগোচ্ছি। কোনো ভুল চোখে পড়লেই চিন্তা করছি পরেরবার কীভাবে দুর্ঘটনা এড়ানো যায়। সফলও হচ্ছি," বলেন তিনি।


অরগানিক খাবারের আন্তর্জাতিক গাইডলাইন মেনে খামার দেওয়ায় মুরগীর দাম বাজারের মুরগীর চেয়ে বেশি। প্রতি কেজি ব্রয়লারের দাম ২৫০ টাকা, কালার বার্ড ৩৫০ টাকা।


"বাণিজ্যিক খামারে মুরগীর খামারে গ্রোথ প্রোমোটার, হরমোন ব্যবহার করা হয়। মুরগীগুলো তাড়াতাড়ি বেড়ে ওঠে এ কারণে। অন্যদিকে, আমরা মুরগীর খাবারে এসব ব্যবহার করিনা। মুরগীর বেড়ে উঠতেও বেশি সময় লাগে। আধুনিক প্রযুক্তিকে খামারের বিভিন্ন বিষয় নিয়ন্ত্রণের কারণেও খরচ বেড়ে যায়," বলেন ইমরুল।


তবে দাম বেশি হলেও চাহিদা কম না। ব্রয়লার ৪০ দিন ও কালার বার্ড ৫৫ দিন বয়সের হওয়ার পর বিক্রি করা হয়। তবে বাজারে পাওয়া মুরগীর চেয়ে দামে বেশি হলেও, অর্ডার করার পর কয়েক মাস অপেক্ষা করতে হতে পারে। এ মাসেই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিক্রির বুকিং নেওয়া হয়ে গেছে। ফ্রিজিং ভ্যানে ডেলিভারি দেওয়া হয়। ইমরুল জানালেন, 'আমি একেবারে সব অর্ডার নিতে পারছি না এতো বেশি চাহিদা"।


পুরো বিশ্ব জুড়েই জনস্বাস্থ্য রক্ষায় অরগানিক খাবারের চাহিদা তুঙ্গে। তবে অরগানিক খাবার নিয়ে কাজ করছে এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কম হওয়ায় বাংলাদেশে অরগানিক খাবারের চাহিদা মেটানো দুষ্কর।


"খুব কম মানুষই এ নিয়ে কাজ করছে। দেশে অরগানিক খাবারের চাহিদা মেটাতে আরও অনেককে এগিয়ে আসতে হবে। ব্যয়বহুল আর প্রযুক্তির ব্যবহার থাকায় প্রয়োজন সঠিক তথ্যের আর প্রশিক্ষণের," বলেন ইমরুল। 


জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় এ খাতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা আর ক্ষতিকর অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে আইন প্রয়োগ প্রয়োজন- মনে করেন তিনি। সেইসঙ্গে দেশের শিক্ষিত তরুণ উদ্যোক্তারা যুক্ত হলেই সম্ভব দেশের সর্বস্তরে খাবারের স্বাস্থ্য ও গুণগত মান নিশ্চিত করা।


অরগানিক চিকেনে'র প্রধান লক্ষ্য গুণগত মান নিশ্চিত করা। ইমরুলের পরিষ্কার কথা, স্বাস্থ্য ও গুণগত মান নিশ্চিত করা সম্ভব না হলে ব্যবসা ছেড়ে দেবেন তিনি। এ অঙ্গীকার নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছে বিদেশে লোভনীয় চাকরি, উন্নত জীবন আর স্থায়ী নাগরিকত্বের সুযোগ ছেড়ে আসা প্রকৌশলী ইমরুলের অ্যান্টিবায়োটিকমুক্ত মুরগীর খামার 'অরগানিক চিকেন'।

Courtesy: The Business Standard

Organic poultry farm at Sreepur provides safe meat