অ্যান্টিবায়োটিক ছাড়া অর্গানিক মুরগি [প্রথম আলো]

২০০৩ সালে বুয়েট থেকে পাস করে দীর্ঘদিন দেশে–বিদেশে টেলিকম ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে সুনামের সঙ্গে কাজ করেছেন ইমরুল হাসান। পেশাগত কারণে দীর্ঘদিন যুক্তরাজ্য, মিসর, ফিলিপাইন, আরব আমিরাতে অবস্থান করার পর ২০১৪ সালের শেষ দিকে দেশে ফেরেন। তথ্যপ্রযুক্তি, পর্যটন ও কৃষিভিত্তিক বিভিন্ন উদ্যোগে সম্পৃক্ত হন। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে একাধিক উদ্যোগ ব্যর্থ হওয়ার পর ঠিক করলেন মুরগির খামার করবেন। শুরু থেকে পণ করেন তাঁর খামারের মুরগিগুলোর কোনো ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করবেন না। 


আমাদের দেশে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ানোর চল আছে। যুক্তরাষ্ট্রের ফুড ও ড্রাগ এজেন্সি জানাচ্ছে, শক্তিশালী ও ভয়াবহ অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার মুরগিগুলোতেই বেশি করা হয়। এ জন্য তাদের কৃষি বিভাগ বলছে, কোনো মুরগিতে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হলে সেই ডোজ শেষ হওয়ার কমপক্ষে ১০ দিন পর ওই মুরগি খাওয়া উচিত।

ইমরুল ভাবলেন, ‘অ্যান্টিবায়োটিক রেসিডিউর ঝামেলাতেই যাব না, অ্যান্টিবায়োটিকবিহীন আমিষ উৎপাদন করব!’ ২০২০ সালের ডিসেম্বরে ইমরুলের মুরগির খামারের যাত্রা শুরু হলো। অ্যান্টিবায়োটিক ছাড়া মুরগি পালনের শুরুটা ভালোই ছিল। শীতকাল হওয়ায় প্রথম দুটি ব্যাচে কোনো ঝামেলা হলো না। তবে গরম পড়ার পরই হোঁচট খেতে হলো। পরপর দুবার অধিকাংশ মুরগি মারা গেল। কর্মীরা অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগের পরামর্শ দিলেন। ইমরুল শুধু মাথা নাড়েন। তত দিনে জেদ চেপে গেছে তাঁর, অ্যান্টিবায়োটিক ছাড়া মুরগি পালনের নিশ্চয়ই কোনো উপায় আছে।


একসময় পেয়েও গেলেন উপায়। ইমরুল বললেন, ‘অ্যান্টিবায়োটিক ছাড়া মুরগি পালনের সহজ উপায় হলো বয়সভেদে শেডের তাপমাত্রা নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে রাখা।’ এটা করার জন্য খাটালেন তাঁর প্রকৌশলবিদ্যা। খামারের বিভিন্ন স্থানে স্থাপন করলেন সার্বক্ষণিক তাপমাত্রা মনিটরিং সেন্সর। বসালেন কুলিং প্যাড। আর নজর দিলেন মুরগির খাবারে।



আমেরিকান ডিপার্টমেন্ট অব অ্যাগ্রিকালচার ও ইউরোপিয়ান অর্গানিক গাইডলাইন অনুসারে, অ্যান্টিবায়োটিকমুক্ত অর্গানিক মুরগি পালনের জন্য নিজেই মুরগির ফিড তৈরি করতে শুরু করলেন। নিজেই গ্রোথ প্রমোটার, মিল বোন মিট ও হরমোন ছাড়া ফিড বানান। দানাদার খাবার তৈরির জন্য ডিজাইন করলেন মেশিন। চীন থেকে সেটি তৈরি করেও আনালেন। মুরগিকে নিয়মিত অ্যাপল সিডার ভিনেগার উইথ মাদার, প্রাকৃতিক বিটেইন, অরেগানু, শজনেপাতা, কাঁচা হলুদ, রসুন, আদা, মরিচ, বিভিন্ন ধরনের শাক, পেঁপেপাতা, নিমপাতা ইত্যাদি খেতে দেওয়া হয়। নির্দিষ্ট উপাদান রক্ষা করে নিজস্ব মেশিনে তৈরি হয় মুরগির দানাদার খাবার।




Mr. Imrul takes care of every step of production by himself. 



ইমরুলের খামারে মূলত ফরাসি হার্বার্ড প্রজাতির কালার বার্ড, ব্রয়লার, দেশি জাতের মুরগি পালন করা হয়। এক দিন বয়সী বাচ্চা নিয়ে আসা হয় হ্যাচারি থেকে এবং জাতভেদে নির্দিষ্ট সময় পালন করার পর নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় হালাল উপায়ে প্রক্রিয়াজাত করে নিজস্ব ফ্রিজিং ভ্যানে করে ঢাকায় সরাসরি গ্রাহকের বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হয়।


গত বছর ২৫ অক্টোবর ইমরুলের অর্গানিক চিকেন খামার নিয়ে একটি প্রতিবেদন করে প্রথম আলো। ইমরুল বলেন, ‘প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর আশাতীত সাড়া পাই। বিনিয়োগ নিয়ে অনেকেই আমার পাশে দাঁড়ান।’


কাজেই চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে পৌনে চার একর জমি লিজ নিয়ে আরও সাতটি শেডে খামারের সম্প্রসারণ করেছেন। ফ্রি রেঞ্জ মুরগি পালনের ধারণাকে মাথায় রেখে শেডগুলো তৈরি করা হয়েছে। ফ্রি রেঞ্জ হলো মুরগিকে শেডের মধ্যে আটকে না রেখে খোলা জায়গায় মাটিতে ছেড়ে দেওয়া। মুরগিগুলো খোলা জায়গায় প্রকৃতির কাছাকাছি পরিবেশে বেড়ে ওঠার সুযোগ পাচ্ছে। 


সব বয়সী মুরগির ফিডই এখন খামারে তৈরি হচ্ছে। আগে প্রথম ১৫ দিন বাজার থেকে প্রি-স্টার্টার ও স্টার্টার খাবার কিনে খাওয়ানো হতো। প্রি-স্টার্টার, স্টার্টার ও গ্রোয়ার—সব খাবারই এখন নিজস্ব ফিড মেশিনে তৈরি করা হয়। খামারের ধারণক্ষমতা এখন প্রায় ৩৩ হাজার, প্রতি মাসেই এখন সব ধরনের মুরগির একটি করে ব্যাচ পাওয়া যাচ্ছে। প্রিমিয়াম রোস্টার এখন নিয়মিত করতে পারছেন বলে জানান ইমরুল। গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য এখন তাঁর বহরে যুক্ত হয়েছে একাধিক ফ্রিজিং ভ্যান ও পিকআপ। 


প্রতিদিনই নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয় উদ্যোক্তাদের। নতুন করে লোডশেডিংয়ের কবলে পড়েছেন। ‘জিরো ইলেকট্রিসিটি’ কনসেপ্টে মুরগি পালা যায় কি না ভাবছেন। ‘এই নিয়ে কিছু পড়াশোনা করেছি। এবারের শীতে একটি পাইলট কার্যক্রমের মাধ্যমে নিজের ধারণাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করব।’ গ্রাহকদের সঙ্গে যোগাযোগর জন্য ফেসবুক পেজ (fb/organikchick), ওয়েবসাইট (https://erp.organikchicken.com.bd) ছাড়াও একটি মোবাইল অ্যাপ তৈরি করছেন, অচিরে যা চালু হয়ে যাবে বলে আশা করছেন ইমরুল।


Courtesy: Prothom Alo

প্রকৌশলী ইমরুল এখন মুরগির সফল খামারি [প্রথম আলো]